
কক্সবাংলা ডটকম(১৬ ডিসেম্বর) :: মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে অসীম আত্মদানের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে স্বাধীন দেশের পতাকা ছিনিয়ে এনেছিল বাংলার মানুষ, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ফিরে এল আবার।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছিল লাল সবুজের বাংলাদেশ, তারই ৫৪তম বার্ষিকী উদযাপন হচ্ছে মঙ্গলবার।
পাকিস্তানি শাসনামলের শোষণ-বঞ্চনা আর সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের শেষে বাঙালির মুক্তি মিলেছিল ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর বাংলা মায়ের আত্মদানের বিনিময়ে।
তারই স্মরণে মঙ্গলবার বিস্তৃত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সব ভবনে উড়বে জাতীয় পতাকা, সাভার স্মৃতিসৌধসহ দেশের সব শহীদ বেদীগুলো ভরে উঠবে শ্রদ্ধার ফুলে। বিজয়ের শোভাযাত্রায় মুখর হবে রাজপথ।
বিজয় দিবসের দিন অন্যান্য আয়োজনের পাশাপাশি সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর যৌথ উদ্যোগে ৫৪ জন প্যারাট্রুপার জাতীয় পতাকা হাতে স্কাইডাইভিং করবেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস অফিস বলছে, এটিই হবে বিশ্বের বুকে ‘সর্বাধিক পতাকা হাতে প্যারাস্যুটিং’, যা গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড গড়বে।
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান সৃষ্টি হয়, বাংলাভাষী এই ভূখণ্ডের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। বৃহদাংশের ধর্ম এক হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতির ভিন্নতায় এ দেশটি যে টিকবে না, অনেক রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকরা তা আঁচ করতে পেরেছিলেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের শোষণ আর বঞ্চনা বাংলার মানুষের মনে জ্বেলে দিয়েছিল ক্ষোভের আগুন। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা যখন হল, সেই ক্ষোভের প্রথম বিস্ফোরণ ঘটল।
সেই পথ ধরে শুরু হল বাংলার মানুষের স্বাধীকার আদায়ের আন্দোলন। বৈষম্যের সঙ্গে নিপীড়ন জাগিয়ে তুলল স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা।
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধিকারের প্রত্যাশাকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা অস্ত্রের মুখে দমন করতে চাইল। ১৯৭১ সালে এই ভূখণ্ডের মানুষের ওপর চাপিয়ে দিল যুদ্ধ। ২৫ মার্চ রাতে চালানো হল ইতিহাসের জঘন্য হত্যাযজ্ঞ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে এই বাংলার মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রতিরোধ যুদ্ধে। নয় মাস যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের যৌথ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করল পাকিস্তানি বাহিনী; লাল সবুজ পতাকা উড়ল স্বাধীন ভূমিতে, নতুন দেশে।
সেই বিজয়ের বার্ষিকীতে বাংলাদেশের মানুষ এক নতুন বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে। চব্বিশের অভ্যুত্থান বদলে দিয়েছে গতিপথ। সেই পথ বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা নির্ধারিত হবে আসছে ফেব্রুয়ারির ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে।
একাত্তরে শহীদদের স্মরণ, বিজয়ের আনন্দ উদযাপনের সঙ্গে এবারের বিজয় দিবস এসেছে ভোটের আমেজ নিয়ে, যেখানে গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রত্যাশার সঙ্গে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও আছে।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ২০ ঘণ্টা পার না হতেই ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদিকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা হয়। ঢাকার একটি আসনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন হাদি।
এ ঘটনায় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ যেমন বেড়েছে, তেমনই বিজয় দিবস উদযাপনেও হাদি থাকছেন সামনে। সর্বাধিক পতাকা হাতে প্যারাস্যুটিং করে বিশ্বরেকর্ড গড়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, তাতে হাদির ছবি আঁকা হেলমেট পরে জাম্প করবেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী।
আওয়ামী লীগের টানা দেড় দশকের শাসনের অবসান এবং সরকার প্রধানের দেশত্যাগের পর গত ষোলমাস বাংলাদেশ এক নতুন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে নানামুখি বিভাজন স্পষ্ট হচ্ছে।
ইতিহাসের ঘটনা বিশ্লেষণে ভিন্নতা থাকলেও সত্য ইতিহাস বিকৃত করা বা বিস্মৃত করার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্ট্রি, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. সারওয়ার আলী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা আমি আশা করব এইটুকু যে, এই মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস, যে আত্মত্যাগ, স্বাধীনতার পরে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, তার প্রাপ্তিতে একটা ব্যবধান হয়েছে। অন্যান্য দেশের মত এ দেশেও এই অপূর্ণতা পূরণ করার জন্য মানুষ আন্দোলন করেছে, সংগ্রাম করেছে। সেটি বাস্তবতা। সেটি অস্বীকার করার কিছু নেই।
“কিন্তু এই কাজটি করতে গিয়ে আমরা যেন কখনো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিস্মৃত না হই। ইতিহাসকে আড়াল না করি। এই কাজটি হলে মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে না।”
জাতীয় রাজনীতিতে যে ‘ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না’ সে বিষয়টি সকলকে উপলব্ধি করার আহ্বান জানান সারওয়ার আলী।
তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের পরে কী কী অপূর্ণতা ছিল বা আছে, এখন সকলেই বলছেন। কিন্তু যাদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ, দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাদের কাছে সকলের ঋণ রয়েছে। সরকার পরিবর্তন হলে মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস, সুবিধাজনকভাবে এর বয়ানটা পরিবর্তিত হয়। কিন্তু ইতিহাস তো অপরিবর্তনীয়।
“ইতিহাসের ঘটনাবলী বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু ইতিহাসকে পরিবর্তন করা যায় না এবং মুছে ফেলাও যায় না। এই সত্যটি সকলকে উপলব্ধি করতে হবে।”
সেই সত্য ফের উচ্চারণ করে সারওয়ার আলী বলেন, “ঐতিহাসিকভাবে সত্য হচ্ছে যে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল যে রাষ্ট্রের তেইশ বছরের জীবনকালে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ভিত্তিতে ক্ষমতার পালাবদল হয়নি। সারা দেশ জুড়ে কোনো নির্বাচন হয়নি।
“এর বিরুদ্ধে এবং রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক যে বৈষম্য, তার বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ যুদ্ধ-আন্দোলন করেছে। করে এক মোহনায় উপলব্ধি করেছে যে স্বাধীনতা ছাড়া এ দেশের মানুষের মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।”
সারওয়ার আলী বলেন, “এই যে জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং এই যে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব, এর কেন্দ্রীয় চরিত্র বাংলাদেশের জনগণ। এটা যেমন সত্য, তেমন এটাও সত্য যে তাদের অগ্রভাগ থেকে কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী এবং ছাত্র সম্প্রদায় এই মানুষকে এই মুক্তির আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করেছিল।
“তবে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশেষ করে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা এবং ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাটা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।”
আর একাত্তরে এ দেশের ক্ষুদ্র একটি অংশ পাকিস্তানের দোসর হয়ে তাদের সহযোগিতা করেছিল, সেই সত্যও স্মরণে রাখার কথা বলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের এই ট্রাস্ট্রি।
তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধকালে যারা সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে, তারা দেশের সাধারণ মানুষ। এটি একটি জনযুদ্ধ ছিল এবং গণহত্যার শিকারও হয়েছে সাধারণ মানুষ। এই মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন হয়েছি। আপনি নিজের মত করে এটি দেখতে পারেন। কিন্তু এই সত্য ও ন্যায় ইতিহাসটা অপরিবর্তনীয়।
“এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য যারা কাজ করেছে, তারা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তান সরকারের অংশীদার হয়েছেন। অখণ্ডতা রক্ষার জন্য পাকিস্তান যা করেছে, তারা তাতে সহযোগিতা করেছেন, সেটাও সত্য।”
বর্তমান সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে হেয় করা হচ্ছে, সেদিকে দৃষ্টিপাত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভূমিকার কথা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিজয় দিবস উদযাপন তো ফিরে তাকানোরও বিষয়। আবার আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ারও পথ ঠিক করাও মূল লক্ষ্য। সেখানে একটা দিক কী, আজকে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করা, বিতর্কিত করা এইসব অনেক চেষ্টা চলছে।
“অথচ হিস্ট্রি ইজ অন আওয়ার সাইড, ইতিহাস আমাদের পক্ষে। কিন্তু সেজন্য ইতিহাসটা জানা, বোঝাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক সেই মুহূর্ত।
গত শতাব্দীতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি যেভাবে বিশ্বের বুকে জায়গা করে নিয়েছিল, সেই প্রেক্ষাপট তুলে ধরে মফিদুল হক বলেন, “বাংলাদেশের অভ্যুদয় কিন্তু বিশ শতকের ইতিহাসে একটা বড় ঘটনা। বড় ঘটনা এই জন্য যে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে এই উপমহাদেশ নানা সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল।
“আর এই সংঘাতের মূল্য আমরা নিজেরাও পাকিস্তানের আমলে দিয়েছি। আমাদের ভাষার অধিকার, আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। আমাদের পদদলিত করা হয়েছে। সেখানে একদিকে সামরিকতন্ত্র, আরেকদিকে হচ্ছে ধর্মতন্ত্র। দুটোর মিশ্রণ তো একটা দেশ। আমরা তো সেটার মধ্যে দিয়ে গেছি।”
তিনি বলেন, “তার বিপরীতে একটা অসাম্প্রদায়িক, সাম্যভিত্তিক সমাজ গড়ার জাতীয় চেতনা নিয়ে…। তো জাতিসত্তার সঙ্গে তো ধর্মসত্তার কোনো বিরোধ নেই। এক ধর্মের মানুষ তো নানা জাতিসত্তার সঙ্গে বসবাস করে। একই দেশেও নানা জাতিসত্তার মানুষ থাকে।
“সেইখানে এই যে ধর্ম এবং সমাজ এবং জাতিসত্তার যে সম্মেলনের জায়গাটা, এটা তো বাংলাদেশই তুলে ধরল প্রথম এই উপমহাদেশে।”
কিন্তু বাংলাদেশ যে সেই সাম্প্রদায়িকতার দীক্ষা ও চর্চা ধরে রাখতে পারেনি, সে কথা তুলে ধরে মফিদুল হক বলেন, “আজকে কিন্তু এই গোটা উপমহাদেশে এই সাম্প্রদায়িকতার বিষে জর্জরিত হচ্ছে। ভারতেও যেটা যেমন সত্য, পাকিস্তানেও সত্য, মিয়ানমারেও সেটা একই ঘটনা ঘটছে বৌদ্ধ ধর্মকে ব্যবহার করে। শ্রীলঙ্কায় ঘটেছে।
“তো সেইখানে সম্প্রীতির মধ্যে সবাই কী করে বসবাস করবে, নিজেদের সত্ত্বাটাকে নিয়ে তারা এগিয়ে যাবে, সেটার একটা পথ করে দিয়েছিল ৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। আমরা সেই পথে এগোতে পারিনি। কিন্তু সেই পথ করে দেওয়ার জন্যে যে আত্মদান এবং সেই পথের যে রেখা, সেটা তো মুছে যাবে না। সেটা নিয়েই আমাদের এগোতে হবে।”
এ গবেষক বলেন, “আমি বলব যে ৭১ এর বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম কিন্তু সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। সেই সংগ্রামের আরেকটা দিক ছিল যে আমরা গণতান্ত্রিক অধিকারের ভিত্তিতেই সংগ্রামটা করেছি। এবং এটা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রাম ছিল না কোনো অবস্থাতেই।
“আর বঙ্গবন্ধু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জনগণকে সংগঠিত করে জনগণের রায় দিয়েই আন্দোলনটা পরিচালনা করেছেন। যে কারণে পাকিস্তান যখন আঘাত করল, তখন কিন্তু সেটার বিপরীতে আমরা সারা বিশ্বের একটা সমর্থন এবং সহযোগিতা পেয়েছি।”
রাষ্ট্র হিসেবে আগামীর পথচলায় তরুণ প্রজন্ম ধর্ম-জাতিসত্ত্বা ও সম্প্রীতির মিলনের বিষয়টি স্মরণে রাখবে বলে প্রত্যাশা করেন মফিদুল হক।
তিনি বলেন, “সব মিলে বাংলাদেশের যে এত অর্জন, সেটা এত সহজে নষ্ট হবে, বিসর্জন দেব আমরা, সেটা হতে পারে না। সেজন্য আজকের দিনের যারা তরুণ, তাদেরকে ইতিহাসটা নৈর্ব্যক্তিকভাবে বিবেচনা করতে হবে।
“এবং সেখানে যে উপাদানগুলো ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা। এবং ধর্মের যে মূল্যবোধ, সেই মূল্যবোধের মধ্যে মানুষের যে মানবিকতা এবং মিলনের যে বাণী, সেটা নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। অর্থাৎ, ধর্মকে যেন কেউ আর রাজনীতিতে এইরকম ব্যবহার করতে না পারে যেটার মূল্য আমরা দিয়েছি একাত্তরে। আর আমরা সেটা দিতে চাই না।”
তিনি বলেন, “সেজন্য তরুণ প্রজন্ম ধর্ম-জাতি-সত্তা-সম্প্রীতি এই সবটার মিলন তারা তৈরি করবে, এটাই চাই আরকি।”

‘অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাও ছিল লক্ষ্য’
বিজয় দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে দেশে ও প্রবাসে বসবাসরত সকল বাংলাদেশিকে শুভেচ্ছা ও উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
তিনি বলেন, “স্বাধীনতা আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন, যার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ শোষণ, বঞ্চনা ও সংগ্রামের ইতিহাস।”
মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সকল বীর শহীদ, যুদ্ধাহতসহ সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা, সম্ভ্রমহারা মা-বোন, শহীদ পরিবারের সদস্য ও স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান রাখা সকল সংগ্রামী যোদ্ধাদের ত্যাগ ও আত্মদানের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতায় সীমাবদ্ধ ছিল না, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য।
“বিগত পাঁচ দশকের পথচলায় জনগণের পূর্ণ রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক মুক্তি এখনো অর্জিত হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়তে নতুন আশা জাগিয়েছে।”
স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হলে গণতন্ত্রকে ‘আরো শক্তিশালী ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ’ দেওয়ার ওপর জোর দেন রাষ্ট্রপতি।
তিনি বলেন, “ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং ঐক্যের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে সকলে একযোগে কাজ করব-এটাই হোক মহান বিজয় দিবসে আমাদের অঙ্গীকার।”
‘শপথ নেওয়ার দিন’
বিজয় দিবস উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে দেশে ও বিশ্বজুড়ে বসবাসরত সকল বাংলাদেশিকে বিজয়ের উষ্ণ শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যে নতুন সূর্য উদিত হয়েছিল, বিগত বছরগুলোতে তা বারবার স্বৈরাচার আর অপশাসনে ম্লান হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা আবারো একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারমুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়েছি।
“বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি উন্নত ও সুশাসিত বাংলাদেশের শক্তিশালী ভিত গড়ে তুলতে যে বিস্তৃত সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, দেশের আপামর জনগণের সম্মিলিত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আজ আমরা সেই কর্মযজ্ঞের সফল পরিসমাপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছি।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমি আশা করি, এর মাধ্যমে আগামীর বাংলাদেশে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমূলে উৎপাটিত হয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে, রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির পাশাপাশি নিশ্চিত হবে জনমুখী ও টেকসই উন্নয়ন।”
জাতির উদ্দেশে সরকারপ্রধান বলেন, “এবারের বিজয় দিবস হোক জাতীয় জীবনে নতুনভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে জনগণের প্রকৃত ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে যে নবযাত্রা সূচিত হয়েছে তা যে কোনো মূল্যে রক্ষার শপথ নেওয়ার দিন।
“আসুন, বহু কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতাকে পূর্ণতা দিতে নতুন প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, সুখী ও সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তুলি। ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলে মিলে হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাই শান্তি এবং সমৃদ্ধির পথে।”
স্মরণে-উদযাপনে
মঙ্গলবার প্রত্যুষে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বিজয় দিবসের কর্মসূচির সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান উপদেষ্টা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
বিদেশি কূটনীতিক এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে।
দিবসটি উপলক্ষে সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনা আলোকসজ্জিত করা হবে।
ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপগুলো জাতীয় পতাকাসহ বিভিন্ন ব্যানার ফেস্টুন ও রঙিন নিশান দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে।
অন্যান্য আয়োজনের পাশাপাশি এবার সর্বাধিক পতাকা উড়িয়ে প্যারাস্যুটিং করে বিশ্বরেকর্ড গড়ার প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ।
বিজয় দিবসের দিন বেলা ১১টা থেকে ঢাকার তেজগাঁওয়ে পুরাতন বিমানবন্দরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী পৃথকভাবে ফ্লাই পাস্ট মহড়া পরিচালনা করবে।
চলবে বিজয় দিবসের বিশেষ ব্যান্ড-শো। সারাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ বাহিনী, বিজিবি, আনসার বাহিনী ও বিএনসিসির বাদক দল বাদ্য পরিবেশন করবেন।
দিবসটি উপলক্ষে এবারও দেশের সব জেলা-উপজেলায় তিন দিনব্যাপী বিজয়মেলা হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত পরিবেশন, কুচকাওয়াজ ও ডিসপ্লে প্রদর্শন করা হবে।
বিকেল ৩টা থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পরিবেশিত হবে বিজয় দিবসের গান। পাশাপাশি সারাদেশের ৬৪ জেলায় একযোগে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান পরিবেশন করবেন নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করবে।
বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
বিকালে বঙ্গভবনে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা দেবেন রাষ্ট্রপতি। এছাড়া, মহানগর, জেলা ও উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ এ উপলক্ষে স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করবে।
দেশের সব হাসপাতাল, জেলখানা, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা, পথশিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র, প্রতিবন্ধী কল্যাণ কেন্দ্র, ডে-কেয়ার ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র এবং শিশু পরিবার ও ভবঘুরে প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রীতিভোজের আয়োজন করা হবে।
সব শিশুপার্ক ও জাদুঘরসমূহে বিনা টিকিটে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে এবং ঢাকাসহ সারা দেশের সিনেমা হলগুলোতে বিনামূল্যে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রদর্শিত হবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র।
চট্টগ্রাম, খুলনা, মংলা ও পায়রা বন্দর, ঢাকার সদরঘাট, পাগলা ও বরিশালসহ বিআইডব্লিউটিসি’র ঘাটে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বাংলাদেশ কোস্টগার্ড একক ও যৌথভাবে জাহাজসমূহ সকাল ৯টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জনসাধারণের দর্শনের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে।

Posted ১২:২০ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta